March 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মোদির বক্তৃতা: মরীচিকার মতোই আশাব্যঞ্জক

বিধান রিবেরু : রাষ্ট্রের কল্যাণ নির্ভর করে কেজো পররাষ্ট্রনীতির উপর:  কৌটিল্য১

হিন্দি সিনেমার রাজনৈতিক নেতাদের মতো ৭ জুন ঢাকায় এক বক্তৃতা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বরের ওঠা-নামা, বাহুর প্রক্ষেপণ এবং শব্দচয়ন- সব মিলিয়ে বেশ ফিল্মি। হাততালিও পেয়েছেন প্রচুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ উদ্যোগে মোদি এই বলিউড মার্কা বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে। তো কী আছে এই বক্তৃতায়? এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে গান ও আবৃত্তি পরিবেশন করা হয়, মোদির সামনে সেই বিষয়ে দুয়েক কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

মোদি অনুষ্ঠানে প্রবেশের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান পরিবেশন করা হয়- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ এরপরই কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাখানা আবৃত্তি করা হয়। অবশ্য মোদি আসার আগে নজরুলের পদ্মার ঢেউরে গানটিও পরিবেশন করা হয়। লালনের মিলন হবে কত দিনে এই গানের মূর্ছনাও ছড়িয়ে দেওয়া হয় মোদির আগমনের আগে। এসব গান ও কবিতা কি নিছক বাছাইয়ের মাধ্যমেই পরিবেশিত হয়েছে? না কি পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ছক করে পরিবেশিত হয়েছে। এমন একটি অনুষ্ঠানে যথেচ্ছভাবে নিশ্চয় বাছাইয়ের কাজ হয়নি। সেটা যদি না হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, বেশ ভেবেচিন্তেই গান ও কবিতা বাছাইয়ের কাজ হয়েছে। সেই বিচারে বাংলাদেশের কূটনীতির প্রশংসা করতে হয় বৈ-কি। একটি দেশের সরকার প্রধানের সামনে কী গান পরিবেশন করা হবে- সেটাও তো কূটনীতির অংশ- না কি?

এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে- মোদির বক্তৃতায়। প্রথমেই তিনি আধো-আধো বোলে বাংলা বলে দর্শক মাতানোর চেষ্টা করেন। এবং সেটাতে তিনি সফলও হন। এদেশে এত মোদি ভক্ত আছে জানা ছিল না। বক্তৃতা শেষে এটি আরও ভালো বোঝা যায়- মোদির সঙ্গে করমর্দন করার প্রতিযোগিতা দেখে। যদিও এদের সকলেই জানেন মোদি আর এদেশের মৌলবাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। আর গুজরাটকাণ্ড তো ভোলার মতো নয়! যাইহোক পুরো বক্তৃতার দুটো জিনিসে আমি মনোযোগ দিতে চাই- এক, জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ, কমপক্ষে চারবার। এবং দুই, ভারতের বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চলার প্রত্যাশা।

জাতিসংঘের ওই এলিট গ্রুপে প্রবেশের জন্য মোদি নয়, মোদির আগে কংগ্রেস সরকার বেশ তোড়জোড় করেছিল, লাভ হয়নি। কিন্তু মোদি হাল ছাড়ার পাত্র নন। বলতে হবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এরা বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরাতে মরিয়া হয়ে আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সদস্য সংখ্যা পাঁচ আর ইদানিং তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জার্মানি, এদের এক সঙ্গে বলা হচ্ছে পাঁচ যোগ এক। কিন্তু বিশ্বের রাষ্ট্রের সংখ্যা কত? আর জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রের সংখ্যাই বা কত? সকলেই জানেন, তাও বলি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৯৮টি। প্রায় দুইশ রাষ্ট্রের ওপর ছড়ি ঘোরানোর মালিক কেন পাঁচ বা ছয়টি দেশ হবে? এটা কি গণতান্ত্রিক? কিন্তু কি অবলীলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের নেতা নরেন্দ্র মোদি কেঁদেকেটে বলে গেলেন তাদের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদ না পাওয়ার কথা। তাহলে কি বলা যায় না- বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারত অগণতান্ত্রিক চর্চার সমর্থক, এমনকি সে অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে চায়? এই স্ববিরোধিতা অবশ্য ভারতে নয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই লক্ষ্য আকারে প্রকাশিত। সেই লক্ষণে এখন আর নাই বা গেলাম। তাহলে হয় তো বলবেন, প্রকৃত গণতন্ত্র কোথায়? কী আর বলব, সেই প্রশ্ন তো আমারও!

ভারতের একার পক্ষে এই মোড়ল হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এজন্য তার দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমর্থন। কাজেই সার্কের সাত দেশকে তার প্রয়োজন।

রবিবারের ওই সন্ধ্যায় মোদি বেদনার সঙ্গে বলেন, বিশ্বে জমি নিয়ে যুদ্ধ হয়, আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে চুক্তি হলো, সেটা দুই দেশকে দূরে ঠেলে দেইনি বরং জুড়ে দিয়েছে। গরিব দেশ না হলে নাকি এজন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য রাস্তায় লাইন লেগে যেত! ভালো কথা। উনি আরও বললেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাজার-হাজার ভারতীয় যুবক মারা গেছে, অন্যদের জন্য, অন্যের যুদ্ধে। ভারত কখনও অন্যের দেশ দখল করতে যায়নি। মোদি এবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গও টানেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয় কিন্তু সেটা নিয়ে তারা কোনও সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেনি। বরং নিজেদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এটা কি শান্তির নমুনা নয়? আর কত উদাহরণ দিতে হবে ভারতকে? মোদি বলেন, জাতিসংঘ থেকে বলা হয় শান্তিরক্ষা মিশনে ভারতীয় সেনাদের অংশগ্রহণ প্রশংসারযোগ্য। তারপরও কেন নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়া হচ্ছে না ভারতকে? গরিব বলে? মোদি এসব বলেই ক্ষান্ত হন না। তিনি আরও যোগ করেন, বিশ্বের জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের বাস ভারতে। তারপরও কেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে না? পাঠক নিশ্চয় জানেন, মোদি যখন এই ভাষণ দিচ্ছেন, অর্থাৎ ৭ জুন, তার ঠিক পরের দিন, ৮ জুন জার্মানিতে শুরু হতে যাচ্ছে জি-৭ সম্মেলন। সেখানে পশ্চিমা হর্তাকর্তারা বৈঠকে বসবেন। ভারতও যে সেই হর্তাকর্তাদের একজন হতে চায়, সেই খায়েশ সুস্পষ্ট।

এখন ভারতের একার পক্ষে এই মোড়ল হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এজন্য তার দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমর্থন। কাজেই সার্কের সাত দেশকে তার প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ভারত এরইমধ্যে ঋণ দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করতে চাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে। শুধু কি ঋণ? নানা কৌশলেই তারা এই কাজ করতে চাচ্ছে। এরই ফাঁকে নিজের অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করতে চায় ভারত। নইলে সমানে সমান পাল্লা দেওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ সফরে এসে এরইমধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ (লাইন অব ক্রেডিট- এলওসি) চুক্তি অনুমোদন করেছে মোদি সরকার। তবে ভাববেন না এই ঋণের বদলে কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই ভারতের। কড়ায়-গণ্ডায় তারা সেই হিসাব বুঝেই নেবে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরেই প্রকাশ যে, এই ঋণ সুবিধা দেওয়ার বদলে ভারত আশা করছে, তাদের কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কেন? কারণ এই ঋণ দিয়ে যেসব প্রকল্প হবে, সেসব প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হবে ভারত থেকে। ৭ জুনের বক্তৃতায় মোদি বলেন, ভারতের জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখেন, একই স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের জন্য (এটা তো আমাদের জন্য শঙ্কার বিষয়!) তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে তারও ভালো লাগে। সে তো লাগবেই, এই ভালোর পেছনে তো ভারতের লাভ আছে সেজন্যই তো ভালো লাগে। কিন্তু এই উন্নয়ন যদি চীনের সঙ্গে হতো তাহলে কি ভালো লাগতো মোদির? এই প্রশ্নের উত্তর উনিই দিতে পারবেন।

৭ জুনের বক্তৃতায় বেশ কাব্য করে মোদি বলেছেন- পাখি, পবন আর পানির ভিসা লাগে না। কথা সত্যি ভিসা লাগে না, তবে পানি পাওয়ার জন্য বাঁধ দেওয়া লাগে। উনি শুধু বলেন ধৈর্য ধরতে, সীমান্ত চুক্তি হয়েছে, তিস্তা চুক্তিও হবে, বিশ্বাস রাখুন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর, বাংলাদেশের আগে মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও নেপালকেও একই শর্তে ৬ বিলিয়ন ডলারের এলওসি দিয়েছে। ২০১৮ সাল নাগাদ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্যের আশা করছে ভারতের ব্যবসায়িক সংগঠন কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি।

স্বার্থ ছাড়া ভারত এক পাও দেবে না এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে সেটিও দূর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মোদি। ৭ জুনের বক্তৃতায় তিনি বলেন, দুই দেশের পণ্য সমানভাবেই দুই দেশে বিক্রি হবে। কিন্তু তিনি বলেন না, সেটা কবে থেকে এবং বাংলাদেশি পণ্যগুলো কী? মোদি বলেন, বিদ্যুৎ উদপাদন হবে। মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। বাংলাদেশকে এক হাজার মেগাওয়াট বিজলি দেওয়ার কথা বলেন তিনি। কিন্তু তিনি বলেন না, রামপালে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুন্দরবন যে হুমকির মুখে পড়েছে সেটার কী হবে? মোদি বলেন, সীমান্তে যে দিক থেকেই গুলি চলুক, তাতে প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের। কিন্তু মোদি বলেন না, বিএসএফের গুলিতে এই পর্যন্ত ফেলানির মতো কত বাংলাদেশি মানুষের প্রাণ গেছে, তিনি বলেন না, বিজিবি কয়বার তাদের দিকে গুলি ছুড়েছে। মোদি বলেন, দুই দেশ একসাথে চলবে, এক পর্যায়ে দৌড়াবে, কিন্তু তিনি বলেন না, ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ৪২টি নদীতেই ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করে, প্রকৃতির পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে সেটার কী হবে। অথচ ৭ জুনের বক্তৃতায় বেশ কাব্য করে মোদি বলেছেন- পাখি, পবন আর পানির ভিসা লাগে না। কথা সত্যি ভিসা লাগে না, তবে পানি পাওয়ার জন্য বাঁধ দেওয়া লাগে। উনি শুধু বলেন ধৈর্য ধরতে, সীমান্ত চুক্তি হয়েছে, তিস্তা চুক্তিও হবে, বিশ্বাস রাখুন। দুদিনের সফরে আস্থা রাখার কথাই বারবার বলেছেন মোদি।

৭ জুনের বক্তৃতাতেও আস্থা রাখার প্রার্থনা করেন মোদি। মোদির এই বক্তৃতা শুরুর আগে গান ও কবিতা বাছাই দিয়ে যে পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশের কূটনীতি, সেটা যদি ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতার ক্ষেত্রেও হয়, তাহলে কৌটিল্যের উদ্ধৃত বাক্য স্বার্থক হবে। তবে এসব চুক্তি ও সমঝোতার পুরোটাই রাষ্ট্রের জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এতে সরকারের লাভ বৈ ক্ষতি নেই।

বোধিনী:

১.Kautilya, The Arthashastra, edited, rearranged, translated and introduced by L.N. Rangarajan, India: Penguin Books. 1992

লেখক: সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email