March 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ইন্টারনেট তার অপসারণ: হুমকিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী মতিঝিল ও দিলকুশায় বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ইন্টারনেট ও টিভি ক্যাবলের ঝুলন্ত তার অপসারণের ঘোষণায় হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আগামী ২১ আগস্ট থেকে তার সরানোর ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লি. (ডেসকো)।

অন্যদিকে আন্ডার গ্রাউন্ডে তার সংযোগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে এমন ঘোষণায় ক্ষুব্ধ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন (আইএসপিএ)। ঝুলন্ত তার সরানো হলে ওই এলাকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

তাদের মতে, নকশাগত ত্রুটি ঠিক না করেই ঝুলন্ত তার অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় ডিপিডিসি ও ডেসকো যদি তার সরানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে তবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, ২ আগস্ট ‘মতিঝিল-দিলকুশা এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটিতে স্থাপিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঝুলন্ত তার/ক্যাবল অপসারণের চূড়ান্ত নোটিশ’ শিরোনামে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে ডিপিডিসি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মতিঝিল-দিলকুশা এলাকায় ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো বিদ্যমান থাক সত্ত্বেও বেশ কিছু ভবনে বৈদ্যুতিক খুঁটি ব্যবহার করে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে ইন্টারনেট ও টিভি ক্যাবলের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত এলাকায় ব্যবহৃত এসব তার ইতোপূর্বে অপসারণ করা হলেও পুনরায় লাগানো হয়েছে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট সকল ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, ক্যাবল টিভি অপারেটর ও ব্যবহারকারীকে আগামী ২১-০৮-২০১৫ ইং তারিখের মধ্যে মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার দৃশ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ ঝুলন্ত তার/ক্যাবলসমূহ (ইন্টানেট/ক্যাবল টিভি) অপসারণ করার নির্দেশ দেওয়া হলো।”

এতে আরও উল্লেখ আছে, “উক্ত তারিখের পর এসব তার পাওয়া মাত্র বিচ্ছিন্ন ও জব্দ করা হবে এবং দায়ী ব্যাক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ডিপিডিসি দায়ী থাকবে না।”

বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল হাকিম নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকা বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এখান থেকে সারাদেশের সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটি কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এ এলাকায় কীভাবে তার অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়, তা বোধগম্য নয়।”

তিনি বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত প্রায় সব প্রধান সড়কে টেকনিক্যাল সমাধান এবং আলোচনার মাধ্যমে তার অপসারণ করে আসছি, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। মতিঝিল এলাকায় ২টি এনটিটিএন-ই আমাদের টেকনিক্যাল সমাধান আজও পর্যন্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে পূর্বে একবার এ এলাকার তার কাটার পরও কিছু কিছু তার আবার আমরা তুলতে বাধ্য হয়েছি। কারণ ব্যবহারকারীদের কাছে লাস্ট মাইল কানেকশনে (শেষ গন্তব্য পর্যন্ত) কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধান না থাকায় আমরা ওভারহেড (ঝুলন্ত) ক্যাবল ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি।”

আমিনুল হাকিম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ডিপিডিসি ও ডেসকো যদি ওই তারিখে ক্যাবল অপসারণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে তার ফলে ইন্টারনেট সেবায় যদি বড় ধরণের কোনো বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়- তার সম্পূর্ণ দায়ভার ডিপিডিসি ও ডেসকোর ওপরই বর্তাবে। এক্ষেত্রে আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।”

আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে তারা সবসময় সহযোগিতা করে আসছে। তারাও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্ছিদ্রকরণের লক্ষ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, এর ফলে নগরীর কোথাও ঝুলন্ত তার অপসারণ করা সম্ভব হবে না।

এর প্রধান কারণ হিসেবে আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের’ নকশাগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করে। তাদের মতে, আন্ডারগ্রাউন্ডের দায়িত্ব যাদেরকে দেওয়া হয়েছে তারা টেকনিক্যাল সমাধান দিতে পরিপূর্ণ প্রস্তুত নয়। ফলে আইএসপিসমূহ যার যার মতো করে তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছে। এতে হাজার হাজার কিলোমিটার তার রাস্তায় ঝোলানো হয়েছে। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এনটিটিএন অপারেটরদের এলডিপি পয়েন্টগুলো বর্তমানে যেভাবে আছে তাতে করে লাস্টমাইল ওভারহেড ক্যাবল (ঝুলন্ত তার) অপরিহার্য। ঝুলন্ত তার এড়াতে হলে এলডিপির সংখ্যা বাড়াতে হবে বলেও জানায় তারা।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার নিউজবাংলাদেশকে জানান, “ইতিপূর্বে এ এলাকায় অপসারণ কার্যক্রম চালানো হয়েছে এটা সঠিক। কিন্তু এর সঠিক সমাধান এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে আমার জানামতে ব্যাংকগুলো আন্ডার গ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তার পরেও যদি কোন সমস্যা হয় সে জন্য আপদকালিন সময়ের জন্য ইন্টারনেট মডেমের ব্যবস্থা করা হবে। তবে মডেম দিয়ে কার্যক্রম চালানো বিপদজনক হতে পারে। তবে ফাইবার অপটিকের সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকিং কাযক্রম বাধাগ্রস্থ হবে।”

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসসি) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক সাকিল রিজভি নিউজবাংলাদেশকে জানান, “এ বিষয়ে আরো বছর দুয়েক আগেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমাদের যেসব স্টেক হোল্ডার (মেম্বার) রয়েছে তারা ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনেকে এর আওতায় আসতে পারেনি। এক্ষেত্রে লেনদেনে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখবো।”

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোথাও পরিপূর্ণ আন্ডার গ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক সিস্টেম চালু নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুটা দূরে ফাইবার অপটিকের স্টেশন রয়েছে। সেখান থেকে ঝুলন্ত তারের মাধ্যমেই সেসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা কাযক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, আন্ডার গ্রাউন্ডে ইন্টারনেট সংযোগের দায়িত্ব পায় সামিট কমিউনিকেশন ও ফাইবার অ্যাট হোম নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। তবে নকশাগত ত্রুটির কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের দোরগোড়া পর্যন্ত এ সংযোগ তার দিতে পারেনি।

ফাইবার অ্যাট হোমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) রফিক নিউজবাংলাদেশকে জানান, “আমরা শতভাগ কাজ করে রেখেছি। তবে ওয়াসার কারণে মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকার কয়েকটি লাইনে সমস্যা হয়েছে, তার সমাধান করা হচ্ছে। এখন যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সরকারের পক্ষ থেকে। এর জন্য আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন কোনো অসুবিধা হলে তারা আমাদের জানালে আমরা সমাধানের জন্য প্রস্তুত আছি। কারণ আমরাতো একে অপরের প্রতিযোগী না। আমরা উনাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছি। ইতিমধ্যে সমস্যা বিষয় জানাতে আমাদের পক্ষ থেকে চিঠি ও ইমেইলের পাঠানো হয়েছে। আমরা চাই সকলের সহযোগিতায় একটি সুন্দর নগরী।”

জানা গেছে, বিদ্যুতের খুঁটিকে জঞ্জালমুক্ত করে ঢাকা মহানগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ঝুলন্ত তার কাটার কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে এর যাত্রা শুরু হয়। তার অপসারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিআরসি, আইএসপি এবং এনটিটিএন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। এর সমন্বয়ের কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

Print Friendly, PDF & Email