নাদীম কাদির লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার। সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছেন অনেকদিন। তিনি একজন শহীদের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তাঁর বাবা লে. কর্নেল মুহম্মদ আব্দুল কাদিরকে চট্টগ্রামের বাসা থেকে ধরে নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করে। সেই শহীদ বাবার স্মৃতিকে নিয়ে নাদীম কাদিরের মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায় গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশনী গত একুশের বইমেলায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে উৎসর্গকৃত বইটি যিনি প্রকাশ করেছিলেন, জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনও সম্প্রতি নিহত হয়েছেন চাপাতির আঘাতে পাক হানাদার বাহিনীর জারজ সন্তানদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের দুই পর্বের দুই শহীদ সহ লাখো শহীদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখন থেকে সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিতভাবে প্রতিদিনের সিলেট-এ বইটির অংশ বিশেষ করে প্রকাশিত হবে।-সম্পাদক ভূ মি কা “মুক্তিযুদ্ধ : অজানা অধ্যায়” আমার অনেক দিনের সাধনার ফল। মুক্তিযুদ্ধ বা বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে বসলেই চোখ অশ্র“সজল হয়ে ওঠে, কণ্ঠ হয় বাষ্পরুদ্ধ এবং হাত চলতে চায় না। তারপরও বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী ও গুণিজনদের প্রেরণায় এই বই প্রকাশ পাচ্ছে। এটি কোনো আত্মজীবনী না। মুক্তিযুদ্ধ ও বাবাকে নিয়ে যে ঘটনাগুলো জানা যায়, সেটুকুই সন্নিবেশিত হয়েছে এই বইতে। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া, বাদ দেয়া বা গোপন রাখার চেষ্টা করিনি। সব ঘটনাই নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তুলে ধরার চেষ্টা বইটিতে আছে। বহুদিনের পুরোনো স্মৃতি থেকে লেখা বলে ছোট-খাটো কিছু বাদ পড়তে পারে। বইটি আমি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে উৎসর্গ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সময় আমার পাশে ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমার আম্মা হাসনা হেনা কাদির যখন মারা যান তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সমবেদনা জানিয়ে আমার দুঃসময়টা অতিক্রম করতে সাহস যুগিয়েছিলেন। এরপর তাঁর কাছে আমি আমার বাবা শহীদ লে. কর্নেল মুহাম্মদ আব্দুল কাদিরের কবরটি সংরক্ষণ করার অনুরোধ জানাই। মহানুভব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার দেহাবশেষ চট্টগ্রাম থেকে কাদিরাবাদ সেনানিবাসে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করে দেন। এ ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাঁকে আমি আপা বলে সম্বোধন করি, দীর্ঘজীবী হোন। ধন্যবাদ জানাই দৈনিক সংবাদ-এর সাব-এডিটর মোহাম্মদ লিংকনকে আমার পাণ্ডুলিপিটা রাত জেগে জেগে গুছিয়ে দেয়ার জন্য। আর রফিকুল ইসলাম রলি, আমার সহকর্মী, তাকে ধন্যবাদ জানাই এ প্রকাশনার কাজে সহযোগিতা করার জন্যে। অনুজ ইমরান মাহফুজ অবরোধের মধ্যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি বাসায় পৌঁছে দিয়েছে এবং প্রকাশনার ব্যাপারে সমন্বয় করেছে। ধন্যবাদ ইমরান। জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার জনাব ফয়সল আরেফিন দীপনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করব না। তারপরও বলতে হবে উনি অনেক ধৈর্য ধরে এই বইটির আদ্যোপান্ত সম্পাদনা করে ঠিক করেন; পুর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থের রূপ দেন। অবতারণিকা আমি একটা কবর চাই। প্রিয় পাঠক হয়তো ভাবছেন কী অদ্ভুত চাওয়া আমার! কিন্তু পুরো বইটি পড়লে জানতে পারবেন এবং আমার বিশ্বাস আপনারাও আমার সঙ্গে আমার চাওয়া বিষয়ে একমত হবেন। ১৯৭১… তখন আমি অনেক ছোট। কিন্তু আজও সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো যেন আমার চোখে ভেসে ওঠে। পাক-হানাদার বাহিনী চট্টগ্রমে আমাদের ৭০ পাঁচলাইশের বাসা থেকে আমার বাবা লে. কর্নেল মুহম্মদ আব্দুল কাদিরকে ধরে নিয়ে গেল ১৭ এপ্রিল। তারপর আর খোঁজ নেই! একজন জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেল! তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে আর ফিরে না আসা। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে শহীদ হওয়া। তখন বুঝতে পারিনি, এই হারিয়ে যাওয়া মানে মাটির নিচে চলে যাওয়া, সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে। কিন্তু উপরওয়ালা যদি চান সব করতে পারেন। বহু দিন, মাস আর বছর পার হয়ে গেল। সঠিক তথ্য পাইনি বাবার শেষ ঠিকানার। আম্মা তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে থাকতে নিজেও সেই ফিরে না আসার দেশে চলে গেলেন। ভালোবাসা কাকে বলে মা আমাকে খুব ভালোভাবে বোঝালেন এই অপেক্ষার প্রহর গুণে। আমার বাবাকে খুঁজে না পাবার বেদনার অনুভূতির সঙ্গে যোগ হলো আম্মার অনির্ধারিত অপেক্ষার কষ্টের অনুভূতি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হঠাৎ ২০০৭-এর শেষ দিকে একটি সূত্রে খবর পেয়ে হাজির হলাম সেই মাটির কাছে। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে। বুক ফাটা বেদনায় মনে হলো ওই মাটির সঙ্গে আমি মিশে যাই। ওই মাটিতেই তো আছে আমার প্রাণপ্রিয় বাবা; ওই মাটিতে মিশে গেলেই তো বাবার কাছে যেতে পারব! ধরতে পারব তার হাতটা। বিষয়টা তাঁর সহকর্মীদের জানালাম। একটি বোর্ড গঠন করা হলো। বোর্ড আমার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করলেন। আমার তথ্য সঠিক প্রমাণিত হলো। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের অনেক অজানা কথাও তখন প্রকাশিত হয়। সেই বোর্ড কিছু সুপারিশও করলো। ঝঢ়বপরধষ ডড়ৎশং ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ঝডঙ) সেনা কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ। আমি তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ যারা এই কাজটি করলেন। কিন্তু মার্চ ২০০৮ থেকে সব কিছু আটকে গেল কোনো এক রহস্যময় অজানা কারণে। শুরু হলো আমার ঢাকা-চট্টগ্রাম ছোটা-ছুটি। কিন্তু চাকরিসূত্রে কর্মস্থল কলকাতায় চলে যেতে হয় আমাকে। মনটা বসাতে পারি না কোনো কাজে। অফিসের কাজে ঢাকায় আসার সুযোগ পেলেই চলে যেতাম চট্টগ্রাম। ঢাকার সেনা সদর, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও আরো কিছু স্থানে ছোটা-ছুটি করলাম। কিন্তু কিছুই করা গেল না, তাঁর কবর সংরক্ষণ অথবা কিছু একটা করা, যেখানে কর্নেল কাদিরের প্রিয় মানুষরা গিয়ে প্রার্থনা করবে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বাবা হারিয়ে গিয়েছিলেন, চলে গিয়েছিলেন আমাদের ছেড়ে। ৩৮ বছর পর সেই ১৭ এপ্রিল ২০০৯ আবার ফিরে এল, কর্নেল কাদির অরক্ষিতই পড়ে থাকলো। খুঁজে না পাওয়ার এক ধরনের ব্যথা! আর এখন যে ব্যথা তা ধরে রাখা যে, কত কঠিন তা কথায় বোঝানো যাবে না। হায়! আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আপনাদের সবার কাছে অনুরোধ-বাবার কবরটা দিন আমাকে, আর তা না হলে, আমাকে মৃত্যুবরণ করতে বলুন! এখন শুধু বাবাকে বলছি, I love you papa.
এ বিভাগের আরো..
কোলকাতায় বিশ্ব কবি মঞ্চ সম্মাননা পেলেন অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
একুশে বইমেলা শুরু হচ্ছে ১ ফেব্রুয়ারি
কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী