ডেস্ক প্রতিবেদন : বাঙালি স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। কারণ ’৭১ সালের এই মার্চ মাসেরই ২৫ তারিখ গভীর রাতে, মানে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছিলো; মনে আছে নিশ্চয়ই? শুধু তাই না, ২৫ মার্চ গভীর রাতে, এদেশের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী; সে ঘটনাও তো তোমাদের জানা আছে। আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কিন্তু ঘটেছিলো এই মাসে। সেটি হচ্ছে- ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। আর সে ঐতিহাসিক ভাষণটি কে দিয়েছিলো, মনে আছে তো? হ্যাঁ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশ শাসকরা। কিন্তু যাওয়ার আগে, উপমহাদেশকে দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করে দিয়ে যায় ওরা- ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দু’টি অংশ ছিলো- পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। আমাদের বাংলাদেশ তখন ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর থেকেই, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের বাঙালিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসছিলো।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাদের দাবির কাছে তাদের মাথা নত করতেই হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি নিয়ে, তবেই শান্ত হয়েছিল বাঙালিরা।
এরপর আরও কত অন্যায়-অবিচার যে করেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তার কোন ইয়ত্তা নেই। অনেকদিন ধরে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে বাঙালিরা। কিন্তু কতোদিন আর এভাবে চুপ করে থাকা যায় বলো? শেষ পর্যন্ত, ঠিকই বাঙালিরা গর্জে ওঠে।
’৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরেও আওয়ামী লীগের হাতে শাসনক্ষমতা দিলো না। আসলে তারা চেয়েছিলো, দেশের পুরো ক্ষমতা নিজেদের হাতেই রাখতে।
শুরু হলো দুর্বার আন্দোলন। ’৭১ সালের ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। সেদিনই, এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ৩ থেকে ৬ তারিখ, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হরতাল পালিত হলো। ৩ মার্চ পালন করা হলো শোক দিবস। সেইসঙ্গে ঘোষণা করা হলো, ৭ মার্চ দুপুর ২টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল গণসমাবেশ আয়োজিত হবে; সেখানে ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভাষণটিকেই বলা হয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা-ই অন্তর্নিহিত ছিলো। বঙ্গবন্ধু তার এ ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিকামী বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। মানুষের মাঝে মুক্তির আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের টনকও নড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন। তারপর ১৯ মিনিটের এক অলিখিত ভাষণ দিলেন; যেন বাংলার মানুষের বুকের কথাগুলোই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো।
ভাষণ শুরু করেছিলেন এইভাবে- ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
এরপর শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলের বিগত আন্দোলনগুলোর কথা বললেন- ‘তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।’
বাঙালির ওপর যে অত্যাচার করা হচ্ছিলো, তার কথাও বললেন- ‘কি পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি। … জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। … আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবো, কার সঙ্গে বসবো? যারা মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? … ২৫ তারিখে এসেম্ব^লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’
তিনি ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু হরতাল হলে তো অনেক গরীব দিন-আনে-দিন খায় মানুষের অনেক কষ্ট হয়; সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর তাই, তিনি সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে ব্যবস্থা করার জন্যও বললেন- ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।’
আর তারপরই তিনি প্রতিরোধের ডাক দেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’
সবশেষে, তিনি উচ্চারণ করলেন সেই অমর বাণী- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
উইকিপিডিয়ার সহযোগী প্রতিষ্ঠান উইকিসংকলনে কিন্তু পুরো ভাষণটাই আছে। নিচে পেইজটার লিঙ্ক দিয়ে দেওয়া হলো-
এ বিভাগের আরো..
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন প্রধানমন্ত্রীর
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে : প্রধানমন্ত্রী
পুলিশকে শান্তি বজায় এবং জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী