March 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি বীরাঙ্গনাদের কাহিনি প্রায় সম্পূর্ণটাই অজানা

ডেস্ক প্রতিবেদন : অনেক পশ্ন জাগে কিন্তু কোনটার পাই আবার কোনটার পাই না। একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের কাহিনি শৈশবে প্রথম শুনি আমারা। পাকিস্তানি সৈনিকরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কীভাবে সেসব বীরাঙ্গনাদের অত্যাচার করে মেরে ফেলে রেখেছিল, সেসব কাহিনি শুনে শিহরিত হয়েছি।
দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণকবরগুলো খুঁজলে দেখতে পাওয়া যাবে সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন অনেক বীরাঙ্গনা। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন এঁদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন সেই নারী তার পরিবারের কাছে হয়ে ওঠে ‘নিখোঁজ’।
 ‘স্বাধীনতা বলতে সবাই মনে করেন ওটা বুঝি সময়ের একটি ঘটনা মাত্র। কিন্তু না। সীমাহীন হত্যা আর যন্ত্রণার পাশাপাশি সেই সময়ের বাতাসে এক অদ্ভুত অনুভূতি ভেসে বেড়াত ।
এসব রোমহর্ষক কাহিনি শুনে শুনে আমরা কল্পনার তল খুঁজে পেতাম না— কীভাবে বাংলাদেশি নারীরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এবং যুদ্ধ করেছিল পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অসংখ্য নারী যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও এবং সর্বতোভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করলেও এটা আসলে সেই ভয়াবহ চিত্রকেই প্রকটভাবে প্রকাশ করে যে, এই যুদ্ধে লক্ষাধিক নারী ও মেয়েশিশু সম্ভ্রম হারিয়েছিল, রেপ-ক্যাম্পে ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে।
সেই অত্যাচারের দুর্ঘটনায় জন্ম নিয়েছিল অসংখ্য যুদ্ধশিশু, যাদের বৃহত্ একটি অংশের খবর বিশ্বের কেউই জানে না। যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই সব বীভত্সতার চিত্র খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে।মা হারানোর বেদনা অনেকে নিজের মত করে সামলে নিতে চেয়েছে। কিন্তু সমাজের কু-প্রবৃতির ও নিচু প্রকৃতির মানুষ সমাজের কাছে এই সন্তানদের অপমানিত করতে লজ্জাবোধ করছে না।

পাকিস্তানি  সৈন্যরা যেসব শহরে ও গ্রামে হানা দিয়েছিল, তার প্রতিটি এলাকায় ওরা নারীদের ধর্ষণ ও অমানুষিক অত্যাচার করার ক্যাম্প খুলেছিল। এটা ওরা করেছিল বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, যার উদ্দেশ্য ছিল—বাঙালির সমাজব্যবস্থার মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়া, তাদের শক্তিহীন করা।

বাংলাদেশের বিজয়ের আগের দু’দিন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। একাত্তরে লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম নষ্ট হয়, মৃত্যু হয়।

আর যাঁরা কোনোভাবে বেঁচে ফেরেন, তাদের বেশিরভাগই ফিরে এসে পরিবারের কাছে আর আশ্রয় পাননি। ধর্ষণের ফলে এই গর্ভবতী নারীরা দেশ স্বাধীনের পর যখন সন্তান প্রসব করেন, তখন অসংখ্য শিশুকে বিদেশিদের কাছে দত্তক দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুর মায়ের মৃত্যু হয় অনাদর-অবহেলা ও স্বীকৃতিহীনতার ভেতর দিয়ে।’

ড. নুসরাত রাব্বীর বাবা ডা. ফজলে রাব্বী একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে নিহত হন। ড. নীলিমা ইব্রাহিম-এর লেখা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ড. নুসরাত (শিরোনাম— দ্য ওয়ার হিরো ইন স্পিক্স)।  তিনি জানিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের তরফ থেকে অফিসিয়াল রণকৌশল হিসেবে বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণ করার ব্যাপারটি গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানিদের দ্বারা কী মর্মান্তিক জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে— আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে এর স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে লড়াই করে যেতে হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে। পাকিস্তানিদের দ্বারা একাত্তরে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে, এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি ওয়ার্ল্ড হলোকাস্ট মহাফেজখানায়।

উইমেনস মিডিয়া সেন্টার এর তথ্য দিয়েছে, বিশ ও একুশ শতকে যুদ্ধ ও গণহত্যার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতা। আর এই নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি ৮ বছরের মেয়েশিশু থেকে শুরু করে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত।  পাকিস্তানি সৈন্যরাও তাদের মিলিটারি ব্যারাকে বাংলাদেশে মেয়েশিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা দাদিমা নানিমাদের গণধর্ষণ করেছে। গণধর্ষণের পাশাপাশি তারা পরবর্তী সময়ে গণহত্যারও শিকার হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে সম্ভ্রমহারা এবং শেষ পর্যন্ত কোনোভাবে বেঁচে ফেরা নারীদের নাম দেন—বীরাঙ্গনা। বীরাঙ্গনা— অর্থাত্ যুদ্ধে যে নারী বিরল বীরত্ব দেখিয়েছেন—এমন একটি অভিধায় ভূষিত করে বঙ্গবন্ধু মূলত সেসব অসহায় নারীকে সমাজের মূল স্রোতে আত্মমর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন।

দুঃখজনকভাবে বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনা বৃহত্তর ক্ষেত্রে সফল হয়নি। পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা লাঞ্ছিত, বিকলাঙ্গ ও গর্ভধারণের শিকার বাংলাদেশি নারীরা যুদ্ধের পর এদেশের সমাজে সম্পূর্ণভাবে অচ্ছুত্ ও ধিকৃত হয়। আর গৌরবময় ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে এমন একটি বিচ্যুতিতে দাঁড়ায়, যার অর্থ— অসম্মানের সঙ্গে একাত্তরে যে নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নতুন সংজ্ঞায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার নারীদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় তখন ৪১ জনের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বীরাঙ্গনারা স্বীকৃতি পেলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। গেজেটে বলা হয়েছে, মৃত বীরাঙ্গনার পরিবারও গেজেটে তাঁর নাম প্রকাশের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবেন। এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বীরাঙ্গনা নিজে বা তার দাবিদাররা মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করতে পারবেন। এরাও অন্য সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মতো মাসিক ভাতা, চিকিত্সা সেবা এবং সরকারি বিভিন্ন শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত কোটার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি বীরাঙ্গনাদের কাহিনি প্রায় সম্পূর্ণটাই অজানা রয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর ও কুখ্যাত গণহত্যা এবং অত্যাচারের বিপুল প্রামাণিক সাক্ষ্য-রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও আমরা এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হত্যা ও নৃশংসতাকে সেই সারিতে তুলে ধরতে পারিনি। এটা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক।

বীরাঙ্গনাদের ইতিহাসকে বিস্মরণের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে বাংলাদেশের নারীবাদী সক্রিয় কর্মীদের বিশেষ দায়িত্ব পালন করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে এখনো যখন অনেক বীরাঙ্গনা বেঁচে রয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। সর্বোপরি এটা তো স্পষ্ট যে, যখন একজন বীরাঙ্গনা মারা যাবেন, তাঁর নির্মম কাহিনিও হারিয়ে যাবে।

আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্ণ হলো। এখনই বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের বিশ্ব সমপ্রদায়ের কাছে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। তাঁদের অত্যাচার ও নিপীড়নকে আমাদের অবশ্যই সম্মান ও সমীহ করা উচিত। বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযোদ্ধা—উভয়েই তাদের জীবন উত্সর্গ করেছে এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য।

সুত্র: সংগ্রহ

Print Friendly, PDF & Email