March 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত একটি পরিবারের অবর্ণনীয় গল্প

ডেস্ক : ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট। কলকাতার রাস্তায় দুই বাসের রেষারেষিতে ঘটে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ওই দুর্ঘটনায় পতিত এক দম্পতিকে একই সঙ্গে ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল। সঙ্গে ছিল তাদের পাঁচ বছর বয়সের সন্তান। তবে তার কোনও ক্ষতি হয়নি।

কষ্ট ছাড়া জীবন হয় না, হতে পারেনা। কারোর জীবনে কষ্টের ছোঁয়া থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কষ্টটা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন কষ্টটা অন্য সবার কাছেই অসহ্যের হয়ে ওঠে। এটি সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত তেমনই একটি পরিবারের অবর্ণনীয় গল্প।

আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, প্রায় চার মাস এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। স্ত্রীর আঘাতের তীব্রতা ছিল মারাত্মক। ডান কাঁধের মাংস এতটাই কাটতে হয়েছিল যে, সাধারণ নকল হাত বসানো যাচ্ছিল না। টানাটানির সংসারে অত্যাধুনিক হালকা হাতের জন্য লাখ দেড়েক টাকা জোগাড় করতে পারেননি ওই দম্পতি।

এই স্ত্রীর নাম জয়শ্রী চক্রবর্তী। একটা হাত হারিয়ে তার জীবনটা পাল্টে গিয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সে।

কলকাতার বেহালায় পর্ণশ্রী এলাকার বাড়িতে বসেই এই দম্পতির স্বামী বরুণ চক্রবর্তী বলছিলেন তাদের জীবনের অমানুষিক লড়াইয়ের কথা। দু’জনেরই ডান হাত কাটা এবং বাড়িতে ছোট বাচ্চা। বাড়ি সামলানো, অফিস সামলানো, বাচ্চা সামলানো এবং পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। বাঁ হাতে লেখা-রান্না থেকে শুরু করে সব কিছু করতে শেখা।

বরুণ  বলেন, ‘আমি কেঁদে ফেলতাম, ভরসা হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু জয়শ্রীর অসম্ভব জেদ আর ধৈর্য। এক বছরের ভিতর বাঁ হাতে ওর অনেকটা রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা হাসিমুখে মানিয়ে নিত।’

জীবনের পরীক্ষা তার পরেও বাকি ছিল। ২০১১ সালে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ল জয়শ্রীদেবীর। শুরু হল আর এক লড়াই। আবার হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় ভয়াল অগ্নিকাণ্ড থেকে একটুর জন্য প্রাণে বাঁচলেন। একটি সংস্থা বরুণবাবুকে একটি কৃত্রিম হাত কিনে দিয়েছিল। জয়শ্রীর দরকার ছিল একটু আধুনিক হালকা কৃত্রিম হাত, যা দিয়ে তিনি ঘরের কাজকর্ম, রান্না, শাড়ি পরার মতো কাজ করতে পারেন।

শেষ পর্যন্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুই সদস্যের সাহায্যে জার্মানিতে তৈরি প্রায় পৌনে দু’লাখ টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) দামের হাত লাগানো হয় জয়শ্রীর শরীরে। যার মাধ্যমে অনেক অসহায়ত্বকে তিনি জয় করেছিলেন।

কিন্তু সাত বছর অসম্ভব যুদ্ধের পর ক্যানসারের কাছে হার মানতেই হলো তাকে। এ মাসের ১০ তারিখ ক্যানসারেই মারা যান জয়শ্রী। মৃত্যুশয্যাতেই স্বামীকে জানিয়েছিলেন শেষ ইচ্ছার কথা— তার কৃত্রিম ডান হাতটি যেন দেওয়া হয় কোনও প্রতিবন্ধী মানুষকে। সেই মতোই ২০ তারিখ তার শ্রাদ্ধের দিনটিতেই হাতটি দান করে দেওয়া হয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে।

জয়শ্রী চক্রবর্তী নিজের জীবন দিয়ে  বুঝেছিলেন অঙ্গহানির অসহায়তা। তাই সেই সাহায্যটাই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন অন্য কোনও সহায়হীনকে। তার শেষ ইচ্ছা হিসেবে কৃত্রিম হাতটি মরণোত্তর দান করা হয়।

বরুণ বলেন, ‘অসংখ্য মানুষের কৃত্রিম হাত-পা দরকার। কিন্তু কেনার সামর্থ্য নেই। একটু ভাল মানের কৃত্রিম হাত-পায়ের  কয়েক লক্ষ টাকা দাম। সরকারি হাসপাতালে এ সব বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা। কিন্তু তার জন্য বছরের পর বছর খাতায় নাম তুলে অপেক্ষায় থাকতে হয়। মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের মতোই কৃত্রিম অঙ্গদানও অনেককে নতুন জীবন দিতে পারে।’

Print Friendly, PDF & Email