March 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ফ্রি ম্যান, নতুন অনুভূতির বিকাশ দেখবে মানুষ

অনল রায়হান : তার মানে এরেনা, সাফাত, রতন, আরিয়েন, আনিস, শম্পা, টুলু, মেঘলা, ইশতিয়াক, ভাবি, নিপুনদা, শাফকাত ভাই, শেখরদা, অমিয়, মামুন, অপু, মনি মামা, মোহাম্মদপুর, গুলশান, গুলিস্তান, ঢাকা, বাংলাদেশ… এরা কেউ নেই! চেনা মানুষ, শহর সব মারা গেছে? তাও সাতশো বছর আগে? আর আমি দিব্যি বেঁচে উঠলাম সাতশো বছর ভূত হয়ে থেকে?
সাতশো বছর পরের পৃথিবীতে আমি।
প্রথমে মনে হয়েছিল মাথাটাকে আচ্ছাসে দেয়ালে কয়েকটা বাড়ি খাওয়াই। কল্পনাভাসি ছেলে আমি। তাই বলে মস্তিষ্কের বাড়াবাড়ি বাঁদড়ামি অসহ্য।এটা নিশ্চয়ই একটা ইডিয়েটের কান্ড। নেপথ্যের সেই ইডিয়েটটাকে হাতের নাগালে পাওয়া দরকার। আমার এখন রীতিমত এক্সারসাইজ করা দেহ… আচ্ছা, তারমানে কি ঢাকার বারগুলোও নেই? সাতশো বছর পরের পৃথিবীতে আবার অ্যালকোহল নিষিদ্ধ না তো?
আমার কি হাসি পেল? পাওয়াই স্বাভাবিক। ঘুম ভাঙার আগে থেকেই গলা বুক সব শুকনো, খড়খড়ে লাগছিল। স্বপ্নে দেখছিলাম, আমি জার্মানির রাইন উপত্যকায় একটা পাহাড়ের খাঁজে খাদে কোথাও দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছি, হাতে ঠান্ডা বিয়ারের মাগ। ওপরের সাদা ফেনাটা খুব ঘন আর খুব সাদা…আচ্ছা জার্মানি বলেও তাহলে এখন কোন দেশ নেই? জার্মান জাতিও কি হাওয়া? বাংলাদেশ নেই বুঝলাম, তাই বলে বাঙালিরা থাকবে না?
আমি কি এই পরাবাস্তব মার্কা খিচুড়িটা মেনে নিচ্ছি নাকি?
‘ধাতস্ত হও অতল, মাথা ঠান্ডা রাখো, অতলে তলাইয়ো না রে বাপ্…’ নিজেকে ধমক দিলাম আমি। অপরূপ মিষ্টি চেহারার যে জাপানি মেয়েটি আমাকে এই সব ঝারিঝুরি শোনাচ্ছিল তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলেছি, ‘আমাকে একটু একা থাকতে দিন প্লিজ।’
‘সিওর’ বলেই মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরটার সাথে একটা কাঠের বারান্দা। ঘরের মেঝে, দেয়াল, ছাদও কাঠের। বিশাল বড় বড় জানালা আছে। সেগুলো বন্ধ। প্রায় সিলিং থেকে হলুদাভ পাতলা কোন কাপড়ের পর্দা নেমে এসেছে মেঝের এক ফুটের মধ্যে। বাইরের দিনের আলো পরিস্কার সেই পর্দা দিয়ে ভেতরে আসছে। ঘরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। জাপানি মেয়েটা যখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো আমার শরীর কেঁপে উঠলো, হা হা করে উঠলো বুক। বাইরে থেকে মেয়েটা এক পশলা অসাধারণ বাতাস নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। মনে হলো, এতক্ষন ধরে আমি আসলে শ্বাসই নিচ্ছিলাম না। এমন শুদ্ধ বাতাসে আমি কখনো নিঃশ্বাস নিইনি। দরজা আধো খোলা রেখেই মেয়েটি তার হিজিবিজি বলছিল। আর আমি কান সটান করে শুনছিলাম বাইরে থেকে ভেসে আসতে থাকা সমুদ্রের গর্জন আর সিগালের ডাক। একটা দুটো নয়, অনেকগুলি সিগাল ডাকছে। ঘুম ভাঙার পর অচেনা ঘর আর তারপরই জাপানি চেহারার মেয়ে, তার বাংলায় কথা বলা আর সাতশো বছরের প্যাচাল আমাকে বিমূঢ় করে ফেলেছিল। নইলে তখুনি আমার ছুটে বাইরে বের হওয়ার কথা! ঘুমিয়েছিলাম মোহাম্মদপুরের গলি ঘুপচিতে, আর ঘুম ভাঙলো সমুদ্রতটে?
কাঠের মেঝেতে হাঁটতে গিয়েই বুঝলাম, কারো গলা দুহাতে চেপে ধরবো সেই শক্তিই আমার নেই। শরীর অত্যন্ত দূর্বল লাগছে। অবশ্য হওয়ারই কথা। অনেকদিন ধরেই জোয়ার ভাটা জ্বরে ভূগছি আমি। রাতে এলেন, বেলায় চলে গেলেন। বেলায় এলেন তো রাতে থাকলেন না। তার ওপর এই জাপানি না আন্তর্জাতিক টেরর বাহিনী নিশ্চিত আমার ওপর কড়া ঘুমের ড্রাগ ব্যবহার করেছে। ঘুমের মধ্যে আমাকে তুলে এনেছে এখানে। কদিন ধরে ঘুমাচ্ছি কে জানে। এখন কি সকাল?
অনেকটা মাতালের মত এলেবেলে হেঁটে গিয়ে আধখোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই আমার প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে গেল। সামনে আদীগন্ত উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো মাঠ। সেখানে কোথাও পাটরঙা আধ মানুষ উঁচু গমের খেত। কোথাও আবার শুধুই সবুজ মাঠ। একই রকম দেখতে একটা গাছের সারি চলে গেছে বহুদূর অবধি। দূরটা ঝাপসা। সবুজ গাছের পাতার ভেতরে ভেতরে নীল রঙের অসংখ্য ফল ঝুলে আছে। কাঠের এই ঘরটা থেকে গাছের সারিগুলি প্রায় সিকি মাইল হবে। তবু আমার মনে হলো, নীল ফলগুলি সম্ভবত আঙুর।
আমার শরীর তিড়তিড় করে কাঁপছে। বাইরের বাতাসটায় বেশ ঠান্ডা। কিন্তু তার চেয়েও অস্বস্তিকর ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চালু হয়েছে আমার মস্তিষ্কে। গমের খেত, আঙুরের খেত মানেটা কি দাঁড়াচ্ছে? এ যে বাংলাদেশ না বোঝাই যাচ্ছে। আমি কি তাহলে ইউরোপে কোথাও?
বাহ্! এই ব্যাপারটা বেশ ভালো। ইউরোপ আমেরিকা হনুলুলু করে বেড়াবার খায়েশ আমার ছোট বেলা থেকেই। এত শখ বলেই বোধহয় ইশ্বর এখনও আমাকে বাংলাদেশ বর্ডারের চৌহদ্দির বাইরে যেতে দিলেন না। অথচ এই জাপানি টেরর বাহিনী আমার সেই খায়েশই পূর্ণ করলো! ঘুমের মধ্যে আমাকে তুলে আনলো এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে! আমার মত নিরামিষ একটা লোকের জন্য এত হাংগামা করার কারন কি?
কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না আমার কিন্তু লাগছে অসাধারণ। এরা এক অপূর্ব প্রাকৃতিক অন্চলে এনে ফেলেছে ্আমাকে। জাপানি তরুনীকে থ্যংকস জানাতে হবে। এমন বিস্তির্ন প্রকৃতির মধ্যে দুটো লার্জ পেগ মেরে হেঁটে বেড়াচ্ছি…আহা, দূর্দান্ত ব্যাপার হবে!
বারান্দার রেলিং এ ঝুঁকে দাঁড়ালাম। বারান্দাটা থেকে চার ধাপ সিড়ি নেমে গেছে মাটিতে। সেখান থেকে চল্লিশ পঞাশ পা গেলেই দু’পাশে উঁচু উঁচু পাইন গাছ নিয়ে একটা পাতা ঝরা হাঁটা পথ মাঠ আর খেতের ভেতর দিয়ে চলে গেছে আঙুরের গাছগুলির মতই দিগন্তে কোথাও। বাঁ দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলো পাহাড়ের চুড়া। কোনো কোনোটার মাথা সাদাটে, ধোঁয়াটে। বরফঅলা পাহাড় জীবনে আমি এই প্রথম দেখলাম। আর সমুদ্র? আমার ডান দিকে বেশ অনেকটা নিচুতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র। অর্থাৎ আমি আর এই কাঠের ঘরটা দাঁড়িয়ে আছি কোনো একটা পাহাড়ের চুড়ায়।
ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা। এ কি করে হয়? প্রায় ছুটে গেলাম ডান দিকে বারান্দার কিনারে। যা ভেবেছি তাই। কাঠের ঘরটার প্রায় কোল ঘেঁষেই আঁকাবাকা ভাবে নেমে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। নিচে গিয়ে মিশেছে সোজা সমুদ্রতটে। ছোট বালুকাবেলা। এখান থেকে পরিস্কার দেখা যায়, বালুকাবেলার তিন দিকই ঘিরে আছে পাহাড়ের ঢাল। মাঝখানের আধা চাঁদের মত যায়গাটায় পাঁচ ছয়শ মানুষ অনায়াসে পাশাপাশি শুয়ে থাকতে পারবে। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সেই বালুর ওপর। আর তার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক ডজন সিগাল আর গলা ফাটাচ্ছে ‘ই ই ই… ক্র্যা ক্র্যা ক্র্যা’ শব্দে।
এ কি কোইনসিডেন্স?

Print Friendly, PDF & Email