March 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

বানরীয় অ্যান্ড দানবীয়

অনল রায়হান: আমি ভালো না খারাপ? আস্তিক না নাস্তিক? সৎ না ভন্ড? হিন্দু না মুসলমান? মানুষ না অমানুষ? সত্য না মিথ্যা? পাহাড় না সমুদ্র? ক্রিকেট না ফুটবল? ভারত না পাকিস্থান? ট্রাম্প না হিলারি? বাঘ না ভাল্লুক?…এরকম হাজার মার্কা দুমুখো ব্যাপারে আমরা নিত্য চিড়ে চ্যাপটা। এই চ্যাপটামি কখনও আনন্দেরও হয়। যেমন পাহাড় না সমুদ্র? এ এক আনন্দিত বিতর্ক। আমি বাঘ না ভাল্লুক? এও মজার। কিন্তু সৎ-ভন্ড, হিন্দু-মুসলমান, আস্তিক-নাস্তিক…এইবার ব্যাপারটা সিরিয়াস দিকে যাচ্ছে। আসলে সিরিয়াস দিকে আমরাই নিয়ে গিয়েছি। শব্দগুলোর দোষ কোথায়! আমি একজন মানুষ হিসেবে ভন্ড হতেই পারি। মানুষ বলেই তো ভন্ড! গরু ছাগল আর ব্যাঙ তো ভন্ড হতে পারবে না। আমি মানুষ বলেই হিন্দু। একটা দেবদারু গাছ তো আর হিন্দু বা মুসলমান হতে পারবে না! আমি মানুষ বলেই অমানুষ হওয়ার ক্ষমতা রাখি। বনমানুষ বা গরিলা কি ভাবে অমানুষ হবে? বৈপরীত্য আছে বলেই মানুষ মানুষ হয়েছে।

মস্তিষ্কের ব্যবহার যত বেড়েছে এই বৈপরীত্য তত জটিল হয়েছে। জটিল চিন্তাপ্রণালী ছাড়া আধুনিক মানুষ অসম্ভব। ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, এই আপনি আর আমি মিলেই কম্পিউটর আপডেট করে চলেছি বছর বছর। অথচ সেই কম্পিউটর ব্যবহার করতে গেলে আমাকে আর আপনাকেই বিষম খেতে হচ্ছে হাজার রকমের প্রোগ্রামিং নিয়ে। এই হলো সেই মস্তিষ্ক, যা লক্ষ বছরের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষকে আর সব প্রাণী থেকে একেবার আলাদা করে দিয়েছে। নতুবা, এই আমাদেরও একসময় পেছনে ল্যাজা ছিল। আমিও কুঁজো হয়ে হাঁটতাম। ধারালো দাঁত দিয়ে কাঁচা মাংস চিবাতাম। আগুন দেখলে ল্যাজা তুলে পালাতাম। স্টিফেন হকিন্স বেড়ে বলেছেন, ‘আমরা তো আসলে বানরেরই একটা উন্নত জাত’। সে আর বলতে! বানরীয় আচরন আমাদের মধ্যে বহাল আনন্দে মহাল বানিয়ে হুঁকো টেনে যাচ্ছে। একে তাকে খোঁচাখুচি না করে এখনও কম্পিউটারসেবী মানুষের অক্সিজেন হজম হয় না। এই দেশে এই আচরনের সাম্প্রতিকতম উদাহরন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মুসলমান সম্প্রদায়ের হামলা।

একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের ওপর আঘাত, মমতার ওপর আঘাত, ভালোবাসার ওপর আঘাত। এই আচরন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হোক আর সাম্প্রদায়িক হোক, এটা হলো বানরীয় আচরনের উন্নত সংস্করণ, যাকে বলে দানবীয় আচরন। যে সময় পত্রিকায় খবর পড়ছি, নেদারল্যান্ড নামক একটি দেশ থেকে কারাগার উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন কতটা বিপরীত মেরুর ঘটনা এখানে, আমার দেশে! একই পৃথিবীর একই অক্সিজেন গিলেও আমরা কি অসামান্য রকমের আলাদা। ঠিক আছে। হতেই পারে। এখানে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের প্যাঁচপ্যাঁচানি আছে।

আজকের ইউরোপ যতই সভ্য হোক, একসময় তারাও আরেকজনের মমতায় গড়া মূর্তি ভাঙতো। এক কোপে অপছন্দের মানুষের কল্লা নামিয়ে দিতো। জোয়ানের মত কত কত মেয়েকে, ছেলেকে এরাই জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। উপনিবেশবাদের যুগে সারা বিশ্বের মানুষকে এরাই দাস বানিয়েছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ এসব হয়েছে। এবং হয়েছে অনেক বছর আগে। যারা ঘটিয়েছে ঠিক সেইরকম বানরীয় বা দানবীয় ইউরোপিয় মানুষেরা এখন সংখ্যালঘু। যে কারনে হিটলারের দেশে হিটলারকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে একজন শয়তানের উদাহরন হিসেবে।

বৃটেনের মানুষ দাবি তুলেছে ভারতের রাজার জগতখ্যাত পাথর কোহিনূর বাকিংহাম থেকে ভারতে ফেরত দেওয়া হোক। ইত্যাদি ইত্যাদির পরেও বর্ণবাদী, সম্প্রদায়বাদী, উৎকট জাতীয়তাবাদী মানসিকতা এখনও ইউরোপে বিদ্যমান। কিন্তু মানুষের মূলধারাটা বদলে গিয়ে জাতপাত সংকীর্নতার উর্দ্ধে চলে যেতে চাইছে। এক পৃথিবীর এক মানুষ…এই অনন্য রোমান্টিক ভাবনারই জোর এখন সেখানে। একটা সময় আসতে বাধ্য যখন সারা পৃথিবীর মানুষেরাই এই ভাবনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। তবে সেই পথে যেতে যেতে কত হাজার লক্ষ নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরবে জগতের মাটিতে সেই ভাবনাটাই অস্থির করে তোলে সুস্থ মানুষকে।

আসলে কিন্তু আমরা সাক্ষি কেবল সত্তর আশি বছরের জীবনের। মানব ইতিহাসের সময়ের বিচারে এ সময় একেবারে চুনোপুটি। আগুনের ব্যবহার থেকে কৃষিকাজে এসে পৌঁছুতে মানুষের হাজার হাজার বছর লেগেছে। দাস ব্যবস্থা থেকে মুজুরীদাসত্বে উন্নীত হতেও কয়েক হাজার বছরের ঘটনা প্রবাহ পাড়ি দিতে হয়েছে। ইতিহাসকে এক দুশো বছর দিয়ে বিচার করা যায় না। সাম্প্রদার্য়িক দাংগা এই ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার বছর ধরেই ঘটে চলেছে। হিন্দু-মুসলমান দাংগার ইতিহাস হয়ত কয়েকশো বছর।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমরা একটা দাংগামুখর সময়ে বাস করছি। আগামী কয়েকশো বছরের ইতিহাস হয়ত অন্য কথা বলবে। হিন্দু মুসলমান ছাপিয়ে মানবধর্মই হয়ত মানুষের আরাধ্য হবে। তবে সে আশায় সুস্থ মানুষ হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে না। শুধু ব্রাক্ষণবাড়িয়া বলে নয়, সবখানে, সব উপজেলা পর্যায়েই সরকারের স্থানীয় প্রশাসনকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে আরও শক্ত হতে হবে। ভালো হতো, স্থানীয় প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে একত্রে কাজ করা। যারা ইতিমধ্যে দানবীয় মনের অধিকারী হয়ে গেছেন, এদের বেহাল হাল ঠিক করা ভারী কঠিন ব্যাপার হবে। কিন্তু যারা এখনও বানরীয় মনের পর্যায়ে আছেন, এদের মনের শুদ্ধতা জরুরী। সাংস্কৃতিক-সামাজিক উদ্যোগ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
আবারও স্টিফেন হকিন্স। ভারী আলুথালু এক কথা বলেছেন তিনি। সেটা হলো, এমনও হতে পারে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীটির এখনও আবির্ভাবই হয়নি! আমরা মানুষ এখন ভাবছি, আমরাই শ্রেষ্ঠ। আমরাই সুন্দর। আমরাই বুদ্ধিমান। পৃথিবীর কিং অ্যান্ড কুইন। কিন্তু সেটা নাও তো হতে পারে। ভবিষ্যতে যন্ত্র আর প্রাকৃতিক মানুষ মিলে এমনই এক অদ্ভূত প্রজাতির বিকাশ হতে পারে যার শারিরীক এবং মানসিক সীমাবদ্ধতা আজকের মানুষের তুলনায় একেবারে কিছুই থাকবে না। সেদিনের সেই বুদ্ধিমান প্রাণীটি কিন্তু ধর্ম-গোত্র-জাত-পাত নিয়ে মোটেই ভাবিত হবে না। সে ভাববে অন্য গ্রহ আর ছায়াপথ নিয়ে। আর আজকের এই দুই হাজার শতকের মানুষের প্রসংগ উঠলে ভ্যা ভ্যা করে হাসবে আর বলবে, ‘মানুষ নামের এই আদীম প্রাণীটি আরেকটু হলে পৃথিবীটাই ধ্বংস করে দিচ্ছিলো! ছ্যা!!’

লেখক: সদস্য প্রজন্ম’৭১

Print Friendly, PDF & Email