ডেস্ক: ভারতের লাখ লাখ বিবাহিত নারী কখনোই তাদের স্বামীর নাম মুখে উচ্চারণ করেননি-স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর উদ্দেশ্যেই এমনটি করেন তারা।
কারণ স্বামীর নাম মুখে উচ্চারণ না করা তার প্রতি একরম শ্রদ্ধা প্রকাশের শামিল মনে করা হয় এবং যুগ যুগ ধরে গ্রামাঞ্চলে এমন প্রথা কঠিনভাবে মেনে চলা হচ্ছে।
কিন্তু এখন নারী অধিকারকর্মীরা গ্রামের এসব মহিলাদের বুঝাচ্ছেন যেন তারা পুরনো অভ্যাস ছেড়ে স্বামীর নাম ধরেই ডাকেন।
বিবিসির গীতা পান্ডে ভারতের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
যদি প্রশ্ন করা হয় একটা বিশেষ নামের মধ্যে কী এমন আছে?
“অনেক কিছু” ভারতীয় বেশির ভাগ বিবাহিত নারীর উত্তর হবে এমন।
তবে এই ‘অনেক কিছু’র পরিস্কার ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেন না কারণ ছোটবেলা থেকে এমনটা শিখে এসেছেন তারা।
“আমার বাবা-মায়ের ৭৩ বছরের বৈবাহিক জীবন। গত বছর বাবা মারা গেল। মায়ের বয়স যখন ১১ তখন তাদের বিয়ে হয় , সেসময় বাবার বয়স ছিল ১৫”।
“প্রথমে তারা উত্তর প্রদেশের একটি ছোট গ্রামে বাস করতো, এরপর তারা কলকাতায় থাকতে শুরু করে। যুগের পর যুগ একসাথে বাস করলেও মা কখনো বাবাকে নাম ধরে ডাকেনি”।
“আমাদের সাথে কথা বলার সময় মা বলতো “তোমাদের বাবুজি”। আর সরাসরি ডাকতে হলে “এই শুনছো বা এই শুনো” এমনটা বলতো মা। আমরা যখন কৈশোরে পা দিলা মায়ের এমন আচরণে হাসতাম। মজা করতাম। বাবাকে নাম ধরে ডাকানোর অনেক চেষ্টা করলেও মা কখনো স্বামীর নাম মুখে আনেনি”।
“মা ছাড়াও আমাদের আশেপাশে যত বিবাহিত নারী ছিল কাউকেই স্বামীর নাম ধরে ডাকতে শুনিনি”। এমনটাই আসলে সারা ভারতের অবস্থা, দেশটির অন্তত দশ লাখ নারী ধর্মীয় বা সামাজিক কারণে নিজের স্বামীর নাম ধরে ডাকেন না।
ভারতীয় সমাজে স্বামীর নাম মুখে আনা বা নাম ধরে ডাকা নিষেধ। প্রথা আছে এমনটা করলে স্বামীর অমঙ্গল হয় বা স্বামীর আয়ু কমে যায়।
এখন যে সমাজে স্বামীকে ঈশ্বরের আসনে বসানো হয়েছে সেখানে নাম ধরে ডাকাতো রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পরে। আর এই কারণে তারা স্বামী নাম ধরে কখনো ডাকে না।
তাহলে কিভাবে ডাকে? ইংরেজিতে অনেকটা ‘হেই ইউ’ আর বাংলায় ‘এই শুনছো’?
তবে ভারতের শহুরে জীবনে এর প্রভাবটা অনেক কম।
এই প্রথা মেনে চলার বিষয়টা গ্রামের দিকটাতে বেশ কড়াকড়ি।
ভিডিও ভলেন্টিয়ার্স নামে একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ এখন ভারতের বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে যে এই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ভাঙতে হবে।
উরিষ্যার মেয়ে মালতি মাহাতু তাঁর জীবনের একটি ঘটনা বলছিলেন এই গ্রুপটিকে।
“একদিন ঘটনাক্রমে স্বামীর নাম ধরে ডেকেছিলাম। আমার ননদ জিজ্ঞেস করেছিল বাইরে কে কে বসে আছে। বাইরে আমার স্বামীসহ যত পুরুষ মানুষ ছিল সবার নাম ধরে বলেছিলাম তাকে” বলেন মালতি।
এরপর ননদ গ্রাম্য পরিষদের কাছে মালতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।
গ্রাম্য শালিস বসে এবং স্বামীর নাম মুখে আনার জন্য মালতিকে দোষী সাব্যস্ত করে ছেলেমেয়েসহ একঘরে করে রাখা হয়েছে।
১৮ মাস ধরে একঘরে হয়ে থাকা মালতির এই ঘটনা ওই অঞ্চলে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।
“পিতৃতান্ত্রিক অনুক্রম ও শাসন যে বিভিন্ন স্তরে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এটা তারই নমুনা” বলছেন সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক এ.আর ভাসাভি।
“স্বামীকে ঈশ্বরের সমান বলা হচ্ছে তাই তার আরাধনা করতে হবে। সামাজিকভাবে সে বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে স্ত্রীকে সহযোগিতার করে তাই সে মালিক ও তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে”।
ভারতীয় নারীরা যেভাবে তাদের স্বামীদের ডাকে
- নারীরা সাধারণত ‘ক বা খ এর বাবা’ বলে ডাকে। অনেকে স্বামীর পেশা উল্লেখ করে ডাকে, যেমন ‘ডাক্তার সাহেব’ বা ‘উকিল সাহেব’।
- তাদের মধ্যে এটাতো অবশ্যই থাকে – ‘এই শুনো’, ‘এই শুনছো’ অথবা ‘আমার কথাটা একটু শোনোতো দয়া করে’ বা ‘তুমি কি শুনছো’?
- ভারতের কিছু ভাষা অনুযায়ী স্বামীকে সাধারণত ‘ভাই’, ‘বড় ভাই’, ‘হ্যালো’ বা ‘মালিক’ বলে ডাকা হয়।
ভিডিও ভলেন্টিয়ার্স নামে স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে বুঝাচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিক এই প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, তারা চেষ্টা করছেন নারীরা যেন এই প্রথা থেকে বের হয়ে আসে।
গত অক্টোবর মাসে এই নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন রোহিনি পাবার। তিনি পুনের একটি গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামটিতে মহিলারা যেন স্বামীর নাম ধরে ডাকেন সেই ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরু করেন তিনি।
তবে সবার আগে রোহিনি সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি আগে নিজের ওপর প্রয়োগ করবেন তিনি, কারণ রোহিনি নিজেও কখনো তাঁর স্বামীকে নাম ধরে ডাকেননি।
বিবিসিকে রোহিনি বলছিলেন ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় এবং গত ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে কখনোই স্বামী প্রকাশকে নাম ধরে ডাকেননি।
“আগে আমি তাকে ‘বাবা’ বলতাম কারণ তার ভাতিজিরা তাকে এভাবেই ডাকতো। অথবা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাকে ‘আহো’ বলে ডাকতাম (মারাঠি ভাষায় ‘আহো’ মানে ‘তুমি’)”-বলেন রোহিনি।
প্রচারণা শুরুর সময়টায় স্বামীকে নাম ধরে ডাকা শুরু করেন রোহিনি।
প্রকাশও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে, তবে গ্রামের অন্য বাসিন্দারা বিষয়টা সহজভাবে দেখেনি।
তবে গ্রামের নারীরা নিজেদের স্বামীদের নাম ধরের ডাকার বিষয়টা নিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন।
“আমরা সেদিন খুব মজা পেয়েছি, হেসেছি অনেক। জীবনে প্রথমবার স্বামীর নাম ধরে ডেকেছি” হাসতে হাসতে বলছিলেন মিস পাবার।
“আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তিনরকম ভাবে স্বামীর নাম ধরে ডাকা হবে। একটা হবে খুশির ডাক, অন্যটা হবে রেগে গিয়ে ডাক এবং আরেকটা হবে ভালোবাসার ডাক।
একজন মহিলা এই বিষয়টা নিয়ে এতই উত্তেজিত ছিল যে সে বাড়ি গিয়ে চিৎকার করে স্বামীকে ডাকলো এবং তার হাতে চড় খেল। ওই মহিলার স্বামী তাকে বলেছে আর কখনো যদি তার নাম মুখে আনার ভুল করে তাহলে তাকে মারধোর সহ্য করতে হবে” বলেন পাবার।
ভারতের বিভিন্ন শহরে অনেক স্বামীর নাম ধরে ডাকার বিষয়টা সাধারণ। কারণ হচ্ছে নারীর শিক্ষায় অগ্রগতি, অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হওয়া এবং দিনে দিনে প্রেমের বিয়ের হার বাড়া অন্যতম কারণ।
“আমার স্বামী আমার সহকর্মী ছিল। আমি বছরের পর বছর তাকে নাম ধরে ডেকেছি। সুতরাং বিয়ের পর সেটা বন্ধ করে দেয়ার কোনো মানে হয় না”।
কিন্তু অধ্যাপক এ.আর ভাসাভি এটাও বলছেন ভারতের খুব কম সংখ্যক এলাকাতে এই অবস্থা দেখা যায়।
“ভারতের বড় শহরগুলোতে শিক্ষিত, চাকরীজীবী নারীদের মধ্যে শুধু এমন চিত্র দেখা যায়। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ নারী এমনটা ভাবতে পারেন না। কিশোরী নারীকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে তার শাশুড়ি বা অন্য কোনো প্রবীণ নারী”- বলেন তিনি।
রোহিনি পাবার বলছেন গ্রামগুলোতে নারীদের মধ্যে পরিবর্তন আনাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়।
“পরিবর্তন সহজ নয়। কিন্তু তাদের নাম ধরে ডাকা দরকার-সমস্যা কোথায়? ছোট ছোট ইস্যুগুলো নিয়ে না এগুলে বড় সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে?”
“এটা হয়তো ছোট পদক্ষেপ কিন্তু প্রথম । আর প্রথম পদক্ষেপই সবসময় বড় কিছু” – বলেন রোহিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এ বিভাগের আরো..
শিশুদের মানসিক অবসাদ
ইসরায়েলি হামলায় গাজায়নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
মেনোপজ: নারীত্ব, যৌনতা, আবেগ, শারীরিক জটিলতা, রজঃনিবৃত্তির প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন