March 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মুক্তিযুদ্ধের গল্প : কলমযোদ্ধাদের একজন

সুমন জাহিদ: মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম চালিকা শক্তি। তিনি পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। সে সময়ের জনপ্রিয় “সাপ্তাহিক বেগম”, “সাপ্তাহিক ললনা”, ‘শিলালিপি’ তে কাজ করতেন। বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দালাল আল-বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন । পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে ১৮ ডিসেম্বর তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ।
শহীদ সেলিনা পারভীনের জন্ম ৩১শে মার্চ ১৯৩১ সালে। তাঁর পিতা মো: আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পরতেন তখন থেকেই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লিখা শুরু করেন। গ্রামীণ কুসংস্কারে মারপ্যাঁচে তাঁর পড়ালেখার সাময়িক ইতি ঘটে তখন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর অমতে তখনকার প্রথামত বিয়ে দেয়া হয়। তিনি ঐ বয়সে স্বামীর সাথে থাকার কথা ভাবতে পারেন নি। কিছু সময় টিকেছিল সে বিয়ে, পড়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকুরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন। তিনি পরবর্তীতে একজন রাজনৈতিক এর সাথে সংসার শুরু করেন। তিনি ‘ললনা’ পত্রিকায় কাজ করতেন বিজ্ঞাপন বিভাগে। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব কাজ একাই করতেন। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না।
‘ললনা’য় কাজ করতে করতে ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ বের করেন ‘শিলালিপি’ নামে একটি পত্রিকা। নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। ‘শিলালিপি’ ছিল তাঁর নিজের সন্তানের মত। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত ‘শিলালিপি’ সকলেরই নজর কাড়লো। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা ‘শিলালিপি’। এই সুবাদে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি।
১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। জাতির ক্রান্তিকাল। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ‘৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে আর সভায়ও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি।
শুরু হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। ‘শিলালিপি’র বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ‘ললনা’ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
‘শিলালিপি’র উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ। হাসেম খানের প্রচ্ছদ করা ‘শিলালিপি’র প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। ‘শিলালিপি’ প্রকাশের অনুমতি মিললো তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে ‘শিলালিপি’র সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান। যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। তাই কাল হলো। ‘শিলালিপি’র আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন।
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। বেশ কিছু অঞ্চল ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। # ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়ীতে থাকতো তিনজন মানুষ- তার পুত্র সুমন, মা আর তার ভাই জনাব উজির। সেদিন শীতের সকালে তারা সকলেই ছিলেন ছাদে। শহীদ সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন শহীদ সেলিনা পারভীন ছাদে একটা চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে।
হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সুমনদের বাড়ীর উল্টো দিকে বাসার সামনে E.P.R.TC-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু লোক। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। সুমনদের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা। শহীদ সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় শহীদ সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। তিনি বলেন,” বাইরে তো কারফিউ, আমি কাপড় বদলে নেই।” তারা বলে, আমার সাথে গাড়ি ও পাশ আছে। সুমন যেতে চাইলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দতে বলে, বার্চা লোক নেহি যায়েঙ্গা- আন্দারমে যাও। শহীদ সেলিনা পারভীন তাঁর ছেলেকে বলে, ” সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও, আমি যাব-আর আসবো”। এটাই তাঁর সাথে জীবনের শেষ কথা (মা-ছেলের)। তাঁরই কোমরের গামছা দিয়ে চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বেধে এরপর তারা শহীদ সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে ধরে নিয়ে যায়।
১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। খুব শীতকাতুড়ে সেলিনার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা । এটি দেখেই তাঁকে সনাক্ত করা হয় । ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেখানেই শহীদ সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।
____________________
# ডাক বিভাগ, স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে, ঢাকার মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কের ও ফেনীতে নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নামে। ডাক টিকেট ও পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে, জাতীয় প্রেস ক্লাবে তাঁর তথ্য সংযোজন আছে। ফেনীতে একটি স্কুলের ভবন ও একটি ক্লাসরুম তাঁর নামে আছে, পাঠাগার হয়েছে।
★ আমার খুব আফসোস হয়, আজকালকার বেশীরভাগ তরুণীরা আর জাহানারা ইমাম, সেলিনা পারভীনদের মত হয় না। গাঁজাখুরি সিরিয়াল, সিনেমার চক্রেই যেন তাদের জীবন ঘুরপাক খায়। আজকের তরুণীই আগামী দিনের মা। তাঁরা যদি ইতিহাস সচেতন না হয়, পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাব কিভাবে? প্রজন্ম জাগো! একাত্তরের চেতনায় জেগে ওঠো।
লেখক: ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন’ এর সন্তান।
Print Friendly, PDF & Email