March 19, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

জননী সাহসিকা

ডেস্ক: গতকাল তাঁর একুশতম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর। জন্ম তাঁর ১৯১১ সালের ২০শে জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জমিদার পরিবারে। তাঁর নামের সঙ্গে প্রথম পরিচয় মা-নানীদের মুখে শুনে শুনে। খুব সম্ভবত: মধ্য পঞ্চাশ দশকে বরিশালে একটি সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে প্রয়াত আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে তিনিও এসেছিলেন।

এ সন্মেলনের একটি অধিবেশন বসেছিল বরিশাল জিলা স্কুলের মাঠে। এক দুপুরে দেখি সেখানে যাওযার জন্যে নানী, মা আর পাড়ার অন্যান্য খালা-চাচীদের মধ্যে সাজ সাজ রব। কারন সে অধিবেশনে বলবেন কবি সুফিয়া কামাল। মায়ের পোঁটলা হয়ে আমার সভাস্হানে গমন ও অধিষ্ঠান। মঞ্চে ফর্সা চশমা পরা আধা ঘোমটা টানা ছোট্ট-খাট্ট মানুষটিকে নিয়ে এতে হৈ চৈ এর কি আছে বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তাঁর ঠোঁটের ওপরে বড় মাসটা দেখে আমার শিশুমন অবাক হয়েছিলো।

দ্বিতীয়বার তাঁর দেখা পেয়েছিলাম আরেক সাহিত্য সম্মেলনে- আমি তখন অষ্টম বা নবম শ্রেণীর ছাত্র। সাহিত্য সম্মেলন বসেছিলো অশ্বিনী কুমার টাউন হলে – আইয়ুবী আমলে যার নামকরণ করা হয়েছিল আইয়ুব খান টাউন হল (আদ্যাক্ষরের পরিবর্তন না ঘটিয়েই)। সবিনয়ে বলি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দূর্দান্ত বিতর্ক করে শিরোপা জিতেছিলাম। প্রধান অতিথি কবি সুফিয়া কামালকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলাম। বিতর্ক শেষে পুরস্কার প্রদানের পরে কাছে ডেকেছিলেন, চিবুক ধরে আদর করেছিলেন, প্রশংসাবাণী উচ্চারন করেছিলেন। মোহিত হয়েছিলাম।

তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয় নবম শ্রেণীতে। ‘সাঁঝের মায়া’ বইটি হাতে এসেছিলো। পাঠ্য বইতেও তাঁর কবিতা ছিলো। কেমন নরম মায়াময় ছন্দের সোজা সরল অর্থের কবিতা তাঁর। পড়ে ভারী ভালো লাগত – উপভোগ করতাম কবি সুফিয়া কামালের কবিতা। নির্মেদ নিটোল তাঁর ভারী মায়াময় কবিতাগুলো আমাকে টানতে।

>সারা ষাটের দশকে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ ও কলম প্রতিফলিত হয়েছে নানান ভাবে। বাংলা ভাষা আরবী হরফে লেখা, রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে পাকিস্তানী শাসকদের সব অপপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার – অবস্হান নিতেন প্রথম কাতারেই। একবার আইয়ুব খান ঢাকায় এসে বুদ্ধিজীবিদের এক সভায় উর্দুতে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশের জনগন হায়ওয়ান (পশু)। কবি সুফিয়া কামাল সঙ্গে সঙ্গে চোস্ত উর্দুতে খান সাহেবকে বলেছিলেন, ‘আপনি তো তা’হলে হায়ওয়ানদের ছদর (পশুদের রাষ্ট্রপ্রধান)’। তাঁর পিতৃগৃহে উর্দু বলার রেওয়াজ ছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কবি সুফিয়া কামালের অনন্য অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে যখন পাকিস্তানের স্বপক্ষে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল, তাতে কবি সুফিয়া কামাল সই করেন নি। এমনই ছিল বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীর প্রতি তাঁর অঙ্গীকার। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিতে তাঁর অনন্যসাধারন অবদানের কথা আমরা সবাই জানি।

আশির দশকের শেষদিকে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে একবার কবি সুফিয়া কামালের ধানমন্ডির বাড়ীতে গিয়েছিলাম। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তখন আমার ‘কড়ি-কড়চা’ নিয়মিতভাবে বেরুচ্ছে। কবি সুফিয়া কামাল সে লেখার প্রশংসা করেছিলেন, বলেছিলেন যে, সে লেখা তিনি নিয়মিত পড়েন। আপ্লুত হয়েছিলাম, মনে আছে।

কবি সুফিয়া কামালের প্রয়াণ দিবসে খুব করে মনে হচ্ছে যে আজকের বাংলাদেশে তাঁর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। জননী সাহসিকার দিক্-নির্দেশনা, চিন্তা-চেতনা ও কর্মযজ্ঞ থেকে আমাদের শেখার বহু কিছু রয়েছে।

লেখক: ডক্টর সেলিম জাহান।

সূত্রঃ তৌহীদ রেজা নূর এর ফেইসবুক থেকে।

Print Friendly, PDF & Email