ড. তৌহীদ রেজা নূর:
এক
একটি মাত্র ছবি পাওয়া যায় যেটি ধারণ করেছে আমাদের ইতিহাসের ট্র্যাজিকতম অধ্যায়। ঘাতকের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বুকে নিজ বাড়ীর সিড়ির নীচে পড়ে রয়েছেন নিষ্প্রাণ বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। দৈনিক ইত্তেফাকের আলোকচিত্রী প্রয়াত আফতাব আহমদের কাছে পরে জেনেছি যে ছবিটি ছিল তাঁর তোলা। পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পরপরই তিনি তাঁর ক্যামেরা হাতে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। বাঙ্গালী জাতির কান্ডারী মহান নেতা সদ্য স্বাধীন বাংলদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ীর সদর দরজা হাট করে খোলা পেয়ে এবং কারো পক্ষ থেকে কোন ধরণের বাঁধা না পেয়ে তিনি ক্যামেরা হাতে সন্তর্পণে প্রবেশ করেছিলেন সে বাড়ীর অভ্যন্তরে। ঢুকতেই দোতলায় যাবার সিড়ির গোঁড়ায় দেখেন ঘরোয়া পোষাক লুঙ্গী-সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত প্রাণহীন বঙ্গবন্ধু মেঝেতে শায়িত। যে মহান নেতার উদ্ধত তর্জনীতে একদিন আন্দোলিত হয়ে সমগ্র জাতি একাট্টা হয়েছে, জালেম শক্তির বিরুদ্ধে প্রান-পণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে সেই শালপ্রাংশু মহামানবের নিথর দেহ দেখে তরুণ আফতাব আহমদের মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকলেও কর্তব্য না ভুলে চোখকে নিবদ্ধ করেছেন ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে। ফোকাস ঠিক করে, ফ্রেম পরিবর্তন করে করে শাটার টিপে গেছেন পাগলের মতো। নানা এঙ্গেলে প্রাণহীন বঙ্গবন্ধুর দুই রিল ছবি তোলার পর মনে করেছেন যথেষ্ট এখন এই অকুস্থল ত্যাগ করাই সমীচিন। দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেছেন ৩২ নম্বররের বাড়ী থেকে নিজের বাহন ভেসপা নিয়ে সোজা ঢাকা প্রেস ক্লাবে। তখনো তিনি জানেন না ঐতিহাসিক সে বাড়ীর ঘরে ঘরে বেগম মুজিবসহ সকলে লাশ হয়ে পড়ে রয়েছেন। ক্ষুধার্ত আফতাব আহমদ নাস্তার অর্ডার দিয়ে নিজেকে ট্রম্যাটিক এক ধরণের মানসিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনায় যখন নিয়ত তখনই তাঁর দুপাশে দুজন মানুষ এসে দাঁড়ালেন। তেনাদের একজন গম্ভীর কন্ঠে আফতাবকে বললেন ‘ক্যামেরা থেকে রিলটি বের করুন। আর যা রিল আছে সাথে সব দিন’। কি করবেন ভাবার আগেই আগন্তুকদের একজন টেবিলে রাখা ক্যামেরাটি নিজের হাতে তুলে নেন, এবং ভেতরে থাকা ফিল্মটি বের করে আনেন। ব্যাগের পাশে থাকা আরেকটি রিলও তারা নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। যাবার আগে আফতাব আহমদকে শাসিয়ে যায় এই বলে যে সে যেন আর ঐ বাড়ীমুখো হবার চেষ্টা না করে। সদ্য তুলে আনা প্রয়াত মহান নেতার এই ছবির সম্ভার হারিয়ে তরুন আলোকচিত্রী আফতাব আহমদের মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। পরে তাঁর মনে পড়ে প্রায় ব্যবহৃত একটি ফিল্মে সে ঐ বাড়ীতে প্রথমে তিন-চারখানা ছবি তোলার পরই তা শেষ হয়ে গেলে তিনি নূতন ফিল্ম লোড করে দুই রিল ছবি তুলেছিলেন, আর প্রায় একদম শেষ হয়ে যাওয়া প্রথম রিলটি রয়ে গেছে নিজ বাহন ভেসপায়। সেই বেঁচে যাওয়া ফিল্ম থেকেই নাকি তিনি সেই একমাত্র ছবিখানা প্রিন্ট করতে পেরেছিলেন – যা আজ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
দুই
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাসায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকেরা হত্যা করার জন্য যখন গুলি ছোঁড়ে তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সশস্ত্র হন্তারকদের দেখে লক্ষণসেনের মতন পশ্চাদপসরণ করেননি, বরং খুনীদের দিকে আরো এগিয়ে গেছেন কালের সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক ছবিতে বঙ্গবন্ধুর গুলিতে-বিদীর্ণ বক্ষ দেখলে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কিছু খুনীকর্তৃক নিছক কোন হত্যাকান্ড ছিল না এর মূলে ছিল বাংলাদেশকে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ অঞ্চলের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে, এ দেশের ইতিহাসকে, বাঙ্গালীত্বকে হত্যা করা। গান্ধীজি, জন এফ কেনেডী, আব্রাহাম লিঙ্কন, আনোয়ার সাদাত বা ইন্দিরা গান্ধীর মতো শুধু টার্গেটেড নেতাকে নয়, শেখ মুজিবর রহমানের ক্ষেত্রে তাঁকে সহ তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে (দেশের বাইরে থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান) – বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নির্বংশ করার ভাবনা থেকে। দেশের ভেতরের ও বাইরের কুচক্রী মহল সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গি পাড়া থেকে আগত এক ক্ষ্যাপা অথচ মানব-দরদী বালক মুজিব তাঁর নির্ভেজাল দেশপ্রেম দিয়ে সকল মানুষের অন্তর জয় করে তুলবে, আর মানুষের মুক্তির সংগ্রামে পুরো জাতির কান্ডারী হবে তা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু তাঁদের অবিশ্বাসের মূলে ছাই ঢেলে দিনে দিনে মুজিবর রহমান হয়ে উঠেছেন মুক্তিকামী সমগ্র জাতির ত্রাতা। স্বাধীন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক চেনা-গোষ্ঠী তাঁকে তাদের চরম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে এমন ক্রীড়নকদের সনাক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে ঝাড়ে-বংশে শেষ করার দায়িত্ব দেয়। কারণ ওরা জানতো কোটি মানুষের প্রাণের গহীনে মুজিবের যে পোক্ত অবস্থান – তা চিরতরে নিঃশেষ করতে হলে প্রথমেই নির্বংশ করতে হবে মুজিব পরিবারকে। দ্বিতীয় দফায় ক্রমান্বয়ে সিস্টেম্যাটিক্যালি এমন সব উদ্যোগ নিতে হবে যাতে ধীরে ধীরে জাতির স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা যায় মুজিবের নাম। বিশেষত আগত প্রজন্মের মস্তিষ্কে রোপন করতে বিভ্রান্তিকর তথ্যের এমন বীজ যাতে তাঁরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে বঙ্গবন্ধু, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা।
তিন
পচাঁত্তরের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয় তা ছিল স্পষ্টতই বাংলাদেশ বিরোধী রাজনৈতিক দর্শনকে নিযুত শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে। তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাস ভূলিয়ে দেবার রাজনীতির অংশ হিসেবে প্রথম ধাপেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গভবনসহ সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে ফেলা হয় মুজিবের ছবি, বাংলাদেশের টাকাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি নিষিদ্ধ হয়, পাঠ্য পুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর নাম, ছবি ও তাঁর রাজনৈতিক জীবনেতিহাস। গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ হয় বংগবন্ধুর ছবি, কন্ঠস্বর কিংবা ভিডিও ফুটেজ। এরপর একে একে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর হত্যাকান্ড বিষয়ে যাতে নব প্রজন্ম জানতে না পারে সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর অনুকরণে চালু করা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। বাংলাদেশ বেতার পাল্টে রাখা হয় রেডিও বাংলাদেশ। এতসব যে হচ্ছিল তার পেছনে স্পষ্টতই মদদ ছিল বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির। পচাত্তরের এই হত্যাকান্ডের পরদিন ১৬ আগষ্ট থেকে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দক্ষিনপন্থী দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পরের কাহিনী তো সবার জানা। সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদ এদেশকে ক্রমশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশে সময়ান্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ব্যানারের ছায়ায় বিভ্রান্ত তরুণ সমাজ গড়ে উঠেছে যারা এদেশের মৌলিক রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশ্বাসী নয়, যাদের চোখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ চরিতার্থ করার জন্য আওয়ামীলীগের উদ্যোগ বৈ কিছু নয়। আশংকাজনক যে, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক নানা পৃষ্ঠপোষকতায় এদের সংখ্যা এ দেশে অনেক বেড়েছে। এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের যে, যখন অন্নদা শংকর রায়ের ভাষায় ‘কাঁদো বাঙ্গালী কাঁদো’ মুডে আমাদের জাতীয় শোকের এই দিনটি পালন করা কর্তব্য তখন এই দেশে একই দিনে রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘কেক কাটা’র নির্লজ্জ সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে।
চার
বেশ অনেকগুলো বছর আগের কথা। দেশের বাইরে যাবার পরে আমার মেঝ ভাই শাহীন রেজা নূর যখন এক ট্যাক্সিতে উঠেছেন – তখন ঐ দেশের নাগরিক সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার জানতে চাইলেন তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন। আমার ভাই দেশের নাম বলতেই সে বললো তাঁকে “তোমরা খুব খারাপ মানুষ কারণ তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছ, যে কিনা তোমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে”।
সম্প্রতি আমি যখন এক সিএনজি চালকের সাথে আলাপ করছিলাম তখন সে বলছিলো “আজকের নেতারা তো তাদের নেতাদের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। এই যে শেখ সাব-এর মৃত্যুদিন আসতেসে তাঁরা কি কইতে পারবো তিনি কৈ পড়সেন, কিভাবে রাজনীতি করসেন?” আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি জানেন?” সে বললো, “হ্যাঁ জানি একটু”। আমার শোনার উৎসাহ দেখে তিনি বলে চললেনঃ “শেখ সা’ব পড়সেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। ঐ স্কুলে জিয়াউর রহমানও পড়সেন। তারপর সেখান থেকে শেখ সাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসা ভর্তি হইসিলেন কিন্তু আর লেখাপড়া শ্যাষ করতে পারেন নাই”। তার জানার মধ্যে অনেক ভ্রান্তি রয়েছে দেখে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই – “আপনি কি শুনসেন কখনো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু কে ছিলেন? কার হাত ধরে তিনি রাজনীতি করছেন?” তিনি খুব দৃঢ়কন্ঠে বললেনঃ “কেন? মৌলানা ভাসানী!” জানতে চাইলাম “কে বলসে আপনারে এই সব কথা?” সে উত্তরে বলল, “ভাই, লেখাপড়া জানি না। আমাদের এলাকার নেতারা কইসে। তাদের কাসেই জানসি এই সব”। বুঝতে পারলাম আমার এই বাহনের চালক যদিও খুব সচেতন নাগরিক, কিন্তু তিনি তাঁর এলাকার নেতাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাননি। এটি তাঁর কোন দোষ নয় – এবং শুধু তিনিই নন তাঁর মতো অগণিত নাগরিক ভূল তথ্য জেনে বড় হয়েছেন। এটি খুব বড় একটি সমস্যা যা থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
পাঁচ
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াশুনা করে শেখ মুজিবর রহমান স্নাতক পাশ করেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী। ১৯৬৩ সালে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাক সোহরাওয়ারদী সংখ্যা প্রকাশ করে, যেখানে শেখ মুজিবর রহমান ‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি সোহ্াওয়ারদীকে একজন দুঃসাহসিক, দানশীল, অদ্বিতীয় ও কাজের মানুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি জোরের সাথে উল্লেখ করেছেন যে তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তিনি কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। সোহ্াওয়ারদী কখনো জনসাধারণকে ‘ধাপ্পা’ দেন নাই এবং সম্ভবত সে কারণেই তিনি পাকিস্তানে রাজনৈতিক কুচক্রের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘তিনি কোন দিনও গুজগুজ রাজনীতি, গোপন কারসাজী, ধাপ্পাবাজী ও চক্রান্তে বিশ্বাস করিতেন না; তিনি কেবল আইনের অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করিতেন’। সেই লেখাতে মুজিব আরও বলেন, ‘তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের খোজ-খবর ও কাজ-কর্মের তত্ত্ব তালাশ করিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেন এবং তাহাদের পরিবারের খরচ প্রদান করিতেন। আমি কলিকাতা ও ঢাকা- এই উভয় স্থানেই তাঁহাকে কিছু সংখ্যক যক্ষা আক্রান্ত রাজনৈতিক কর্মীর চিকিৎসা ও তাহাদের পরিবারের খরচ প্রদান করিতে দেখিয়াছি’। এমনকি তাঁর মতে ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে সম্ভবত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাজপ্রাসাদ হইতে গরীবের কুটির পর্যন্ত সর্বত্র নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারিতেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে, শহীদ সোহরাওয়ারদীর অবিশ্বাস্য সাংগঠনিক দক্ষতাই ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ ছিল। এবং তাঁর মতে, “নেতার অন্তরে অনেক উচ্চে ছিল কর্মী এবং ছাত্রদের স্থান”। সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ারদীর সেই বিষয়টির আলোকপাত করেছেন তাঁর লেখায়। অন্যদিকে ১৯৬৯ সালের ১ জুন ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মারা গেলে তিনি ‘আমাদের মানিক ভাই’ শিরোনামে লেখায় উল্লেখ করেন, “আমরা পথ প্রদর্শককে হারিয়েছি। কিন্তু সেই পথের রেখা আমরা কিছুতেই মুছে যেতে দেবো না। বরং তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তাঁরই পতাকা হাতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে’। ১৯৪৪ সালে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর কলকাতার বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রথম দেখা হয়েছিল মানিক মিয়ার সাথে। এরপর মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু’র সম্পর্ক আরো প্রগাঢ় হয় রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে। সেখানে ইত্তেফাক ছিল মূল মাধ্যম। আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন সেখানে থাকার কারণে দৈনিক ইত্তেফাক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ছড়িয়ে দেয়ায় খুব গুরত্বপূরণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে হলে সেই সময়টিকে বুঝতে হবে যখন তিনি ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠছিলেন। তাহলেই আমরা বঙ্গবন্ধু কি হিমালয়সম বিস্তৃতি নিয়ে আমাদের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন তা উপলব্ধি করতে সমর্থ হবো।
লেখক : শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন এর সন্তান, গবেষণা ও লেখক এবং শিক্ষক ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস। (পুন:প্রকাশ)
এ বিভাগের আরো..
অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক নয়
সংসদ সদস্যকে আইন প্রনয়ন নয়, মানতেও হবে
জাতীয় চারনেতা হত্যা নেপথ্যে থাকা কুশলীব কারা